আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রাজস্ব আয় বাড়াতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছে সরকার। অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারায় নিয়ে আসার সুযোগ না থাকলে বেকায়দায় পড়বেন অনেক বৈধ ব্যবসায়ী। এ কারণে বিষয়টি বিবেচনার জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন এ বিষয়ে আইন প্রণেতা সংসদ সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেবেন।
আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংকোচনমূলক নীতি-কৌশল আরো কিছুদিন চালু রাখার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। আগামী ছয় মাসের মধ্যে তার ফল দেখার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আশা করছি, এ বছরের শেষ দিকে (ডিসেম্বর) কমতে শুরু করবে মূল্যস্ফীতি। দেখা যাক, চেষ্টা তো করতে হবে। আপনারা এটাও লক্ষ করেছেন, বাজেটের আকার আমরা অনেক কমিয়ে রেখেছি, যাতে কোনো প্রেসার না পড়ে প্রাইসের ওপর।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ ফিরিয়ে আনায় বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, অডিটজনিত কারণে কিছু ব্যবসায়ী তাঁদের বৈধ সম্পদ রিটার্ন দাখিলের সময় দেখাতে পারছেন না, সে কারণে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে
দেশের রীতি অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পরদিন সংবাদ সম্মেলন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে ১০ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সচিবরা। গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এই সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
এরপর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন অর্থমন্ত্রী। তবে এদিন বেশিক্ষণ নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি তিনি। এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের মন্ত্রী বলেন, ‘আগে প্রশ্ন করা শিখুন, তারপর প্রশ্ন করুন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকের ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা না করে প্রশ্ন করবেন না। অর্থনীতির আকার ছোট হয়েছে—এই ধরনের কথা আপনি কোথায় পেয়েছেন? আপনার কাছ থেকে এমন প্রশ্ন আশা করিনি।’
দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ
আগামী অর্থবছরের বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে যাঁরা নিয়মিত কর ৩০ শতাংশ দেন, তাঁরা নিরুৎসাহ হবেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘এটা করা হয়েছে মূলত বিভিন্ন কারণে কিছু অপ্রত্যাশিত অর্থ থাকে, যেটা কোনো কারণে রিটার্নে দেখানো হয়নি। জমি ক্রয়-বিক্রয়ে আমাদের অজ্ঞাতেই অপ্রদর্শিত থেকে যায়। এ রকম কিছু কারণে যে টাকা রিটার্নে দেখানো হয়নি, সেটা বৈধ করা।’
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘কালো টাকা ভোগ-বিলাসের জন্য বেশি ব্যবহার করা হয়। জমি কেনাবেচা করার সময় কিছু টাকা অপ্রদর্শিত হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে যাঁরা রিটার্নে যেসব সম্পদ দেখাতে পারেননি, সেই সম্পদ দেখানোর জন্য এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা অনেক দেশেও দেওয়া হয়ে থাকে।’
মূল্যস্ফীতিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ যেহেতু এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, সেহেতু সংকোচনমূলক নীতি-কৌশল আরো কিছুদিন চলমান থাকবে।’ তবে সংকোচনের নীতির মধ্যে প্রবৃদ্ধির ধারা যাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখার কথাও বলেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘সংকোচনমূলক নীতি অনুসরণ সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরে ৫.৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আগামী অর্থবছরে আমরা ৬.৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হব।’
মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ
আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
সংকোচনমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ আরো কিছুদিন চালু থাকবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি এবং এটা নিয়ন্ত্রণে আমরা আরো কী করতে পারি, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি।’
সরকার নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। তিনি বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমাতে আমরা ভর্তুকির পাশাপাশি ন্যায্য মূল্যেও পণ্য বেচব।’
ঋণ নিয়ে চিন্তার কারণ নেই
বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরতার সমালোচনা অনেকে করলেও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলছেন, এ নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।
ব্যাংকের তারল্য সংকটের সময়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন, এতে ব্যাংকে তারল্য সংকট হবে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া, এটা তো একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর। এটা সব বাজেটেই সব অর্থমন্ত্রীরা করে থাকেন। সব সরকার করে থাকে। উন্নত দেশ আরো অনেক বেশি নিয়ে থাকে, আমরা তো মাত্র ৫ শতাংশের মধ্যে এটা ধরে রেখেছি। কাজেই এটা এত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।’
রিজার্ভ বাড়াতে পদক্ষেপ আছে
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এমন কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, বাজেটের আকার আমরা কমিয়ে রেখেছি, যাতে অনেক বেশি ধার করতে না হয়।’
রিজার্ভ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান জানান, বিদেশ থাকা প্রবাসীদের জন্য দেশের ব্যাংক খাতে ডলারে বিনিয়োগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে ভালো সাড়া মিলবে বলেও আশা করেন তিনি।
সরকারি চাকরিজীবীরা সর্বজনীন পেনশনভুক্ত হবেন
২০২৫ সালের পর সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যুক্ত হতে হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
অর্থমন্ত্রী বলেন, পেনশন সুবিধা পায় এমন সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা হবে। এরই মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের এ ব্যবস্থার আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
যৌক্তিক কর অযৌক্তিক বললে কষ্ট লাগে
যেসব কর নির্ধারণ করা হয়েছে, তা যৌক্তিক। অনেকে যৌক্তিক করকে অযৌক্তিক বলছেন, এতে কষ্ট লাগে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। শেয়ারবাজারে অনেক কর প্রণোদনা দেওয়া ছিল। এতে কিছু ফুলে-ফেঁপে ওঠেনি। শেয়ারবাজারে সমস্যা অন্য কোথাও। তিনি বলেন, ‘কর ছাড়ের জায়গা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে চাই। এবার অনেক ক্ষেত্রে কর ছাড় অব্যাহতি সংকুচিত করেছি।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জনবল বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থসচিব খায়েকুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘জনবল নিয়োগের বিষয়ে এনবিআর থেকে চিঠি এসেছিল। এরই মধ্যে আমরা ব্যাপক জনবল বৃদ্ধি করেছি।’
গত বৃহস্পতিবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এটি বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদসচিব মো. মাহবুব হোসেন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। সে জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা কেউ তাঁর বক্তব্য শুনব না। তিনি যেন কোনো বক্তব্য না দেন, সে বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বক্তব্য দিলে আমরা তা বয়কট করব।’
এরপর পুরো সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেননি গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সংবাদ সম্মেলনের বেশির ভাগ সময় গভর্নরকে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায়।
|