গত এক বছরে (২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত) নানাভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫৮৮ জন। এর মধ্যে ৫২ জন নিহত হয়েছেন।
ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে এই পরিস্থিতি উত্তরণে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়নসহ ৬ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক ও নির্মল রোজারিও, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয়, কাজল দেবনাথ, বাসুদেব ধর ও সুব্রত চৌধুরী, সাংবাদিক নিখিল মানকিন, ইঞ্জিনিয়ার শুভদেব কর প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বিগত বছরগুলোর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরে সহিংসতার ঘটনার খুব বেশি হেরফের হয়নি। এক বছরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ৪৫টি হত্যাকণ্ড ঘটেছে। এ ছাড়া সাতজনের মরদেহ উদ্ধার (হত্যাকাণ্ড বলে প্রতীয়মান) হয়েছে। এই সময়ে ১০ জনকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে, ৩৬ জনকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে, ৪৭৯ জন হামলা ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার এবং ১১ জনের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়েছে। বসতঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১০২টি। বসতবাড়ি ও জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে ৪৭টি, বসতবাড়ি ও জমিজমা দখল ও উচ্ছেদের তৎপরতা ও হুমকির ঘটনা ঘটেছে ৪৫টি এবং ১১টি দেশত্যাগের বাধ্য করার চেষ্টা হয়েছে। দেবোত্তর, মন্দির ও গীর্জার সম্পত্তি দখল ও দখল চেষ্টার ১৫টি ঘটনা ঘটেছে। শ্মশানভূমি দখল ও দখলের চেষ্টার ৭টি ঘটনা ঘটেছে, মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ৯৪টি ঘটনা ঘটেছে, প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে ৪০টি, গণধর্ষণ, ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টা হয়েছে ২৫টি, অপহরণ, নিখোঁজ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ১২টি ঘটনা ঘটেছে এবং ধর্ম অবমাননার কল্পিত অভিযোগে আটজন আটক হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনে ৩২টি ও স্থানীয় নির্বাচনে ৫টি সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে।
ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধে ওই প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন প্রয়োগের বাধা দূর করতে হবে। সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ব আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণের’ ধারা সুরক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ‘এথনিক ক্লিনজিং’ অপনীতির কবলে যেসব অমানবিক ঘটনা ঘটেছে, তার বিচারকার্য সম্পন্ন ও তার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও চা বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান ঘটাতে হবে। সকল অনগ্রসর অঞ্চলের সুষম উন্নয়ন ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের দেওয়া নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়ে ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন, বৈষম্য বিলোপ আইন ও দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ আইন করবে। জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু সেই অঙ্গীকারগুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও সরকার, রাষ্ট্র, প্রশাসন ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ থাকায় প্রধানমন্ত্রীর অনেক সদিচ্ছা বাস্তবায়ন হয় না। তারপরও আমরা আশা করি, নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত অঙ্গীকার বাস্তবায়নে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সরকার।