ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের মাস পূর্তির দিন পদত্যাগ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব নেওয়া এই কমিশন আড়াই বছরে বিদায় নিল।
আজ বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসিসহ পাঁচ কমিশনার পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
ঘোষণা শেষে পদত্যাগপত্রে সই করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। এরপর অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারও পদত্যাগ করেন। সিইসিসহ তিন কমিশনার ইসি সচিব শফিউল আজিমের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন, যা রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠনো হবে বলে জনিয়েছে ইসি সূত্র।
সংবাদ সম্মেলনে সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আহসান হাবিব খান ও মো. আলমগীর উপস্থিত ছিলেন।
অপর দুই কমিশনার মো. আনিছুর রহমান ও বেগম রাশেদা সুলতানা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত না থাকলেও ইসি সচিব শফিউল আজিমের কাছে সকালে তারা পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে ইসি সূত্র।
সংবাদ সম্মেলনে বিদায়ী বক্তব্য সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আপনাদের অবহিত করতে চাই, আমিসহ মাননীয় কমিশনারগণ দেশের পরিবর্তিত বিরাজিত অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনস্থ করেছি। আমরা অদ্যই পদত্যাগপত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতি সমীপে উপস্থাপনের নিমিত্ত কমিশনের সচিব মহোদয়ের হাতে দিব। কশিনের সদস্যরা সংবিধান মেনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন।’
কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে জানিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসির ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিষ্পন্ন করা অতিশয় কঠিন একটি কর্মযজ্ঞ। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সকল দোষ বা দায়-দায়িত্ব সকল সময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। কিন্তু সকল সময় সকল কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না।
পদত্যাগের ঘোষণার আগে কমিশন সংস্কার প্রসঙ্গে বিদায়ী এই কমিশনার বলেন, আমাদের বিশ্বাস, বিদ্যমান ব্যবস্থায় কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশি শক্তিবিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের অন্যান্য সকল নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্কিত বা সন্দিপ্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন পরবর্তী সকল নির্বাচনগুলো সতর্কতার সাথে আয়োজনের চেষ্টা করেছে। জাতীয় এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে দিনের বেলায় ব্যালট পেপার প্রেরণ, কতিপয় উপনির্বাচনে ভিডিও পর্যবেক্ষণ, ইভিএম ব্যবহার, দেশের সকল জেলায় একই দিনে তবে প্রতিটি জেলার প্রশাসনিক সীমানার মধ্যে মাঝে ৩/৫ দিন বিরতি দিয়ে ৫/৬টি ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে রদবদল ইত্যাদি গৃহীত ব্যবস্থা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল। নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে। মধ্যে হয়নি। Within হয়েছে Not Between.’
লিখিত বিদায়ী বক্তব্যে আরো বলা হয়, ‘কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুই বছর সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২টি, উপজেলা পরিষদের ৪৯৬টি, জেলা পরিষদের ৭১টি, পৌরসভার ৯০টি এবং সিটি কর্পোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনগুলোর সততা, সিদ্ধতা, নিরপেক্ষতা অবাধ হওয়া নিয়ে অতীতের ন্যায় ব্যাপক বিতর্ক বা সমালোচনা হয়নি। উপ-নির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮ টি আসনে কমিশন নির্বাচন করেছে। দলীয়ভাবে ইনক্লুসিভ না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। এটি সঠিক ও যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে সেচ্ছায় নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সেই কারণে নির্বাচন হয়নি এমন উদাহরণ নেই। সরকার বারবার বলছেন, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারংবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এই কথাটির মধ্যেই নিহিত।’
সংবাদ সম্মেলনে বিদায়ী বক্তব্য শেষে সাংবাদিকদের কোন প্রশ্নের জবাব দেননি বিদায়ী সিইসি হাবিবুল আউয়াল। সংবাদ সম্মেলন শেষে নির্বাচন ভবন ত্যাগ করেন সিইসিসহ তিন নির্বাচন কমিশনার। এ সময় সিইসিকে তার ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে চলে যেতে দেখা যায়।
এ দিকে সংবাদ সম্মেলনে না থাকলেও দুপুর পৌনে ১টায় নির্বাচন ভবন ত্যাগ করতে দেখা যায় নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা ও আনিছুর রহমানকে। তাদের সঙ্গে ছিলে কমিশনার মো. আলমগীর। এ সময় কমিশনের বাইরে অবস্থানকারী ছাত্র-জনতা কমিশনারদের গাড়ি উদ্দেশ্য করে জুতা ছুড়ে মারেন।