নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করে আসছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সরকার পতনের আন্দোলন বেগবান করতে তারা চাইছে ঐক্য, যার নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি। সেই পথে জাতীয় পার্টিকেও পাশে চায় দলটি। বৃহত্তর ঐক্য ও আন্দোলন সফল হলে সহযোগী সব দল নিয়ে সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ মিত্র রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রাথমিক সংলাপও সম্পন্ন করেছে বিএনপি। বিএনপির এ বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায় এখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জাতীয় পার্টিতে। বিএনপির একটি সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে দেশ-বিদেশে নানান চাপে রয়েছে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ এসব ইস্যুতে জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। আওয়ামী লীগের সংকট আরও প্রকট হলে জাতীয় পার্টি তার রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। আর সেই ৎ পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে বিএনপি তার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। বিএনপি আগামীতে রাষ্ট্রক্ষমতায় এককভাবে যাওয়ার কথা ভাবছে না। যে কারণে নামসর্বস্ব ওয়ান ম্যান পার্টি খ্যাত রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও সরকারের অংশ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। সাংগঠনিক সক্ষমতা ও আসনভিত্তিক সক্ষমতা অনুযায়ী আন্দোলন সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলোর মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে সংলাপে। সেক্ষেত্রে প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে বিএনপিতে। গত ১৯ আগস্ট নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াসের বিয়ের অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের একই টেবিলে বসার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে দুই দলের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে নানা গুঞ্জন শুরে হয়। বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বিএনপির সঙ্গে কোন উপায়ে ঘনিষ্ঠ হতে পারে সে বিষয় দলের পক্ষ থেকে সূক্ষ্মভাবে ভাবা হচ্ছে। জাতীয় পার্টি অধিকাংশ সময়ই ক্ষমতার বলয়ের সুবিধাভোগী। আওয়ামী লীগ থেকে এমপি পেয়েছে মন্ত্রী পেয়েছে, এ সুবিধাজনক অবস্থান থেকে বিএনপির সঙ্গে কেন আসবে? সেই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। যেহেতু জাতীয় পার্টি ক্ষমতার সুবিধাবাদী একটি রাজনৈতিক দল সেহেতু তাদের নিয়ে সেভাবেই ভাবা হচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব সংকটের কারণে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আন্দোলন করে বিএনপি। এবার আন্দোলন সফল হলে প্রয়োজনে বিএনপি জিএম কাদের নেতৃত্বে আগামীতে সরকার গঠন করবে। কৌশলগত কারণে জিএম কাদেরকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাবনা দিতে পারে বিএনপি। তবে এর বিপরীত মতামত রয়েছে। অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরের বলয়টি কোনোভাবেই আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চান না। তারা ভেতরে ভেতরে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। কারও কারও মতে এ যোগাযোগ বেশ জোরেশোরেই চলছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, সম্প্রতি জিএম কাদের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর সফর করলেও সফরটি ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। ঠিক ওই সময়টাতেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য মির্জা আব্বাসসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছিলেন। জিএম কাদের ও মির্জা আব্বাস একই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন। সিঙ্গাপুর সফর শেষ করে দেশে এসেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের তার বক্তব্যের ধরন পাল্টে ফেলেছেন। যদিও তিনি অনেকদিন ধরেই বলে আসছেন আমরা আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই। ভবিষ্যতে কোন জোটে যোগ দেবো তা সময় বলে দেবে। গত ২০ মে একটি অনুষ্ঠানে জিএম কাদের বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। সবগুলো আসনে ইভিএমে ভোট হলে সরকারদলীয় প্রার্থীরা প্রকাশ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। জাতীয় পার্টি প্রহসনের নির্বাচন চায় না। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে জাপার আগের অবস্থান ছিল বিএনপির ঠিক বিপরীতে। তারা শক্তভাবে তত্ত্বাবধায়কের বিপক্ষে কথা বলতেন। দলটির বক্তব্য ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের সঙ্গে সঠিক আচরণ করেনি। তাই আমরা তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে না। কিন্তু হঠাৎই জিএম কাদের সুর পুরো বদলে ফেলেছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও জানা যায়, জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপির রাজনীতিতে আসা কিংবা বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে যাওয়া এমন অনেক নেতাদের পরস্পরের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ কিংবা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। পারস্পরিক নানা আলোচনা থেকে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানও বোঝার চেষ্টা করছেন বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ। যেখানে আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় রয়েছে বলেও নেতাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন। বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির ভোট একত্র হওয়ার কারণে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় মহাজোট প্রার্থীদের বিজয় শুধু নিশ্চিতই হয়নি, অনেক সহজও হয়েছে। এরশাদের জাতীয় পার্টি এখনো নির্বাচনে অন্যতম ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ রয়েছে বিএনপির এমন একাধিক সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে সবদলকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে চায় বিএনপি। সেক্ষেত্রে এরশাদের জাতীয় পার্টি ‘ইভিএমে ভোট’ নাকচ করার পাশাপাশি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতেও একটা পর্যায়ে গিয়ে একমত হবে এবং সরকার পতনের কার্যকর আন্দোলন গড়ে উঠবে বলে আশা করছেন তারা। সম্প্রতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ দলের কয়েকজন নেতা সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছেন। জাতীয় পার্টিকে আপনারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্ব দেওয়ার চিন্তা করছেন কি না?— জবাবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ সরকারকে এবার আর ভোট লুট করতে দেবো না। এ কারণে আওয়ামী লীগ ছাড়া আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। সেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে এখন যদি জাতীয় পার্টি শরিক হয়, যুগপৎ আন্দোলনে আসে অবশ্যই আমরা স্বাগত জানাবো। রাষ্ট্র মেরামতের আন্দোলনে যারা আমাদের সঙ্গে আসবে সবাইকেই স্বাগত জানাবো। ক্ষমতাসীনদের বলয়ের সুবিধা থেকে বিরোধী শিবিরে আসবে কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে আহমেদ আজম খান বলেন, এটা তারা বলতে পারবে। যদি তারা বিরোধী শিবিরে আসে, একটা জিনিস আপনি মনে রাখবেন, সাগরে সাঁতরানোর চেয়ে সাগর পাড়ি দিতে হলে আপনি কিন্তু একটা খড়-কুটোর ওপর নির্ভর করতে চান। সেই কারণে কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে সবাইকেই সহযাত্রী হিসেবে চাই। তারা যদি আসে স্বাগত জানাবো। ‘এখন তারা আসবে কি না, কেন আসবে এ প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারবো না। জনগণের মুখের ভাষা তারা বুঝুক। রাষ্ট্রের এ সংকট মুহূর্তে তারা এবং জনগণ আমাদের পাশে দাঁড়াক এটা প্রত্যাশা করি। জনগণ প্রত্যাশা করে, রাষ্ট্র প্রত্যাশা করে। এসব বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, জাতীয় পার্টি কাদের সঙ্গে যাবে এটা তাদের ব্যাপার। নির্বাচনের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।