দেশের সম্ভাবনাময় সিরামিক শিল্প এখন রপ্তানিমুখী খাত। গত কয়েক বছরে এই খাতটির অগ্রগতি অভূতপূর্ব। মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই মেটাচ্ছে দেশের সিরামিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। রপ্তানিতেও বেশ চাহিদা আছে বাংলাদেশে উৎপাদিত সিরামিক পণ্যের। সম্প্রতি গ্যাস সংকটে খাতটির ওপর রীতিমতো নেমে এসেছে অশনি সংকেত। এলাকাভেদে দিনে শিল্প এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকছে ছয় থেকে ১২ ঘণ্টা। অথচ সিরামিক কারখানার জন্য মেশিন ২৪ ঘণ্টা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রেখে চালু রাখা জরুরি। এতে রপ্তানিতে স্থবিরতা নেমে আসার পাশাপাশি দেশের চাহিদা মেটানোই কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভালুকায় টাইলস ও সিরামিকের তৈজসপত্রের আলাদা দুটি কারখানা গড়ে তুলেছে এক্সিলেন্ট সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। গত মার্চ মাস থেকে গ্যাস সংকটে গুনতে হচ্ছে লোকসান। হাতে প্রচুর বিদেশি ক্রয়াদেশ থাকলেও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় তা সরবরাহ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে এক্সিলেন্ট সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হাকিম সুমন জাগো নিউজকে বলেন, এখনো ফ্যাক্টরিতে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না। আমাদের মেশিনগুলো ২৪ ঘণ্টা কাজ করার পরিকল্পনা করে বসানো। উৎপাদন ৫০ শতাংশে নেমেছে। মেশিনের কর্মক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। উৎপাদনের পরিকল্পনায় ব্যাংক লোন নেওয়া আছে। লাভ তো দূরের কথা, কীভাবে লোকসান কমানো যায় সেই চেষ্টা চলছে গত মার্চ থেকে। প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছি, চেষ্টা করছি রক্তক্ষরণটা কমানোর। আব্দুল হাকিম আরও বলেন, সরকার যদি এ খাতটাকে একটু আন্তরিকতা দেখাতো তবে আমরা টিকে যেতে পারতাম। আমি এখন রপ্তানি করতে পারছি না। প্রচুর অফার রয়েছে। পুরোনো ক্রেতারাও অন্যের কাছে চলে যাচ্ছেন। এ গ্যাসে পণ্য উৎপাদন করলেও মান অবনমন হচ্ছে। শুধু এক্সিলেন্ট সিরামিক নয়, গ্যাস সংকটে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে সামগ্রিক সিরামিক খাত। দেশের অভ্যন্তরে সিরামিকের বাজার ১০ হাজার কোটি টাকার। পাশাপাশি প্রতি বছর বিদেশে যাচ্ছে আরও পাঁচশো কোটি টাকার সিরামিক পণ্য। চলতি বছর এ চাহিদা অব্যাহত থাকলেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে থমকে গেছে শিল্পটি। কারখানার উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশের বেশি কমাতে বাধ্য হয়েছেন উদ্যোক্তারা। তারা জানান, গ্যাস সংকটে বাজারে ঠিকঠাক পণ্য দিতে পারছেন না। আবার রপ্তানি পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো ক্রয়াদেশ কমাচ্ছে। এতে সিরামিক রপ্তানিও নেতিবাচক ধারায় চলে গেছে। সার্বিকভাবে এবছর খাতের টার্নওভার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমছে।বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, গ্যাসের কারণে আমাদের এবছর তিন হাজার কোটির মতো টার্নওভার কমছে, যা সার্বিক বাজারের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এ ক্ষতির কারণে অধিকাংশ কোম্পানি লোকসানে পড়বে। বিশেষ করে ছোট ছোট অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এখন গ্যাসের সংকট কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত মাসে গাজীপুর এলাকার কারখানায় দিনে ১২ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ থাকতো না। এখন ছয় ঘণ্টা থাকে না। সে কারণে গাজীপুর এলাকায় পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সাভারে এখনো কারখানা চলছে না। সেখানে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকে না। নারায়ণগঞ্জেও এমন খারাপ অবস্থা। সেখানেও বড় ঘাটতি রয়েছে। বিসিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে সিরামিক খাতে বর্তমানে ৭০টি প্রতিষ্ঠান আছে। যার অধিকাংশ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সাভার, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের মতো এলাকায়। এসব কারখানায় সিরামিকের তৈজসপত্রের পাশাপাশি টাইলস ও স্যানিটারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ২০টি তৈজসপত্র, ৩২টি টাইলস ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনের ১৮টি কারখানা চলমান। গত কয়েক বছরে এ খাতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। যাতে একসময়ের আমদানিনির্ভর এসব পণ্যের এখন প্রায় ৮০ শতাংশ দেশে তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি রপ্তানিও হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে ৫০টিরও বেশি দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের সিরামিকস পণ্য। সিরামিক কারখানার মালিকরা বলছেন, তাদের পণ্য প্রস্তুতে চুল্লিতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ থাকতে হয়। সেই হিসাবে এই শিল্পে গ্যাস একটি অন্যতম কাঁচামাল। পণ্য উৎপাদনে ১০-১১ শতাংশ খরচই হয় গ্যাসের পেছনে। দিনে অনেক সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হয় গ্যাস সংকটের কারণে। চুল্লি বন্ধ করলে আবারও গরম করতে গ্যাস অনেক বেশি লাগে। এছাড়া সিরামিক পণ্য পোড়াতে গ্যাসের প্রেশার দরকার হয়, কারণ চুল্লি রাখতে হয় ১২শ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তাপমাত্রা কমে গেলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। পণ্যের মান খারাপ হয়ে যায়। জানতে চাইলে আর্টিসান সিরামিকসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মামুনুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, এখনো রাত থেকে ভোর পর্যন্ত গ্যাসের চাপ না থাকায় উৎপাদন কম হচ্ছে। দীর্ঘদিন গ্যাসের এ সংকটের কারণে লোকসান গুনছি। উৎপাদন কমে যাওয়ায় রপ্তানি ঠিকমতো হচ্ছে না। বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে পারছি না। তাতে ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এদিকে সংকট কাটাতে অনেক শিল্প-কারখানা সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস নিচ্ছে সিএনজি ফিলিং স্টেশন থেকে। এতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। এর আগে গত ১৯ অক্টোবর বিসিএমইএ পেট্রোবাংলা এবং সিএনজি স্টেশন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনকে চিঠি দেয়। চিঠিগুলোতেও সিএনজি স্টেশনগুলো থেকে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের জন্য সহযোগিতা চাওয়া হয়। যদিও সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তারপরেও কিছু প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে সিলিন্ডারে গ্যাস নিচ্ছে।