আবুল মনসুর আহমেদ বিশেষ প্রতিবেদকঃ
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু ঢাকার। বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ৮টায় ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই-বায়ুর মান সূচক) স্কোর ২২৫। বায়ুর মান বিচারে এ পরিস্থিতি খুবই অস্বাস্থ্যকর। একিউআই স্কোর শূন্য থেকে ৫০ ভালো হিসেবে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ মাঝারি হিসেবে গণ্য করা হয়। আর সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। একইভাবে একিউআই স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত হয়। আর ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। বায়ুদূষণ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এটা সব বয়সী মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি, প্রবীণ ও অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য বায়ুদূষণ খুব বেশি ক্ষতিকর। প্রশ্ন হলো—ঢাকার বায়ু এত দূষিত কেন? এক কথায় এর উত্তর ‘অব্যবস্থাপনা’। সময় ও বাস্তবতার প্রয়োজনে উন্নয়ন, কলকারখানা, যানবাহন সবই প্রয়োজন। তবে সেই সঙ্গে প্রয়োজন হয় ব্যবস্থাপনারও। গত ৩১ জানুয়ারি আদালতের নির্দেশনা অনুসারে ঢাকায় বায়ুদূষণ রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। এরই সূত্র ধরে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে উচ্চ আদালতের ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। হাইকোর্টের নির্দেশনার পর বায়ুদূষণ রোধে অভিযান কালবেলা পত্রিকা অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন হাইকোর্টের ৯ দফার মধ্যে রয়েছে—ঢাকা শহরে মাটি/বালু/বর্জ্য পরিবহন করা ট্রাক ও অন্যান্য গাড়িতে মালামাল ঢেকে রাখা; নির্মাণাধীন এলাকায় মাটি/বালু/সিমেন্ট/পাথর/নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা; সিটি করপোরেশন রাস্তায় পানি ছিটানো; রাস্তা/কালভার্ট/কার্পেটিং/খোঁড়াখুঁড়ির কাজে দরপত্রের শর্ত পালন নিশ্চিত করা; সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে গাড়ির চলাচল সময়সীমা নির্ধারণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধ করা; পরিবেশগত সনদ ছাড়া চলমান টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ করা; মার্কেট/দোকানের প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা এবং বর্জ্য অপসারণ নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘দূষিত বায়ুর কারণে মূলত ফুসফুসের সংক্রমণ ঘটে। এ ছাড়া সর্দি, কাশি, যক্ষ্মা, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা রোগের সংক্রমণ বাড়তে পারে। কিডনি ও চোখের সমস্যাও হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের হার বাড়ে। তিনি বলেন, ‘আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। কিন্তু বায়ুদূষণের কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকাবাসীর গড় আয়ু আট বছর কমছে।’ গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘ব্রিদিং হেভি : নিউ এভিডেন্স অন এয়ারপলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বায়ুদূষণে প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ মারা যান। (সূত্র : ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩; প্রথম আলো) বায়ুদূষণ কমার সুফল ১. স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার বলছে, বায়ুদূষণ রোধ করতে পারলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়বে এক বছর তিন মাসের বেশি। ২. বায়ুদূষণ কমানো গেলে নিজেদের আর্থিক সাশ্রয় যেমন হবে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে। মানুষের অসুস্থতা কমবে, গড় আয়ু বাড়বে, সময় সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি বেড়ে যাবে জিডিপিও। ৩. বায়ুদূষণ রোধ করা গেলে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রকোপ রোধে ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়তা’ হবে। ৪. বায়ুদূষণ রোধ করা গেলে, বায়ুদূষণের ফলে মানুষের শরীরে যেসব রোগের সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে, সেগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা কমিয়ে ফুসফুসের সমস্যা, হৃদরোগ, চর্মরোগসহ অনেক রোগ কমে যাবে। ৫. দূষণরোধ করতে পারলে প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নেওয়ার সংখ্যা কমে যাবে, তেমনি শিশু ও মানুষের গড় আয়ু বাড়বে। কেন বায়ুদূষণ বেশি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা, ঢাকার মতো বড় শহরের চারপাশে ইটভাটা, শহরের মধ্যে নানা কারখানা স্থাপন, শহরের প্রচুর ধুলা এবং নির্মাণকাজ বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। ট্রাফিক জ্যামের কারণে অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করে গাড়িগুলো বায়ুদূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত গরম থেকে বাঁচতে মানুষ অতিরিক্ত এসি ব্যবহার করছে, তাতেও বায়ুদূষণ বাড়ছে। ঢাকায় অসহনীয় বায়ুদূষণে বিপন্ন স্বাস্থ্য-অর্থনীতি বায়ুদূষণ যেভাবে কমানো যেতে পারে বায়ুদূষণ কমাতে আমাদের প্রত্যেকের সচেতন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে। করোনার সময় মাস্ক ব্যবহার বাড়লেও বায়ুদূষণে মাস্ক ব্যবহার করলে দূষণ থেকে অনেকাংশে রক্ষা মিলবে। সঙ্গে আরও যেসব কাজ করা যেতে পারে তা হলো— ১. পরিকল্পিতভাবে কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমিয়ে আনা। ২. কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া। ৩. ট্রাফিক জ্যামের সমাধান। ৪. উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করা। ৫. এয়ার কন্ডিশনার কম ব্যবহার করা। ৬. প্রচুর বনায়ন করা, কারণ গাছ বায়ুদূষণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে। ৭. বাড়িঘর ও আবাসিক এলাকাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা, যেখানে উদ্যান ও পুকুর থাকবে। ৮. নির্মাণকাজগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে করা, যাতে সেটি দূষণের কারণ না হয়। ৯. শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা। ১০. নির্মাণকাজের সময় নির্মাণ স্থান ঢেকে রাখা, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেওয়া। ১১. রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা। ১২. অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো। ১৩. ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা।
|