প্রবন্ধ লেখক: জিনিয়া জিন্নাত, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, শিবপুর, নরসিংদী
টেকসই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে মূল শিক্ষার ভিত্তি। প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। ২০০১ সালে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন বিশ্বে শিক্ষা ফোরাম থেকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বিশ্ব ফোরাম থেকে ২০৩০ সালের জন্য গৃহীত হয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। এর মূলমন্ত্র হচ্ছে Leave no one behind অর্থাৎ কাউকে পিছনে ফেলে নয়। যেখানে উন্নয়নের মূলমন্ত্রই হবে টেকসই উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন। এসডিজির-৪ নম্বরের অভীষ্ট হলো শিক্ষা ব্যবস্থায় সার্বিক গুণগত মানোন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের সকল প্রকার মানুষের জন্য টেকসই, কল্যাণকর জীবন ও জীবিকার সুযোগ এবং সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। এসডিজির ৪.২ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ছেলে মেয়ে যাতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসহ শৈশবের একেবারে গোড়া থেকে মানসম্মত বিকাশ ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে তার নিশ্চয়তা বিধান করা। ইতিমধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ এমডিজিতে সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণগত অর্জনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এসডিজি অভীষ্ট অর্জনে পরিমাণের চেয়ে টেকসই শিক্ষার গুণগত মানের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই এসডিজি অর্জনের সফলতার জন্য প্রয়োজন গুণগত মানসম্পন্ন টেকসই প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।
শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মানবিক মূল্যবোধ বদলে দিতে সহায়তা করে। আর মানসম্মত শিক্ষা হচ্ছে সেই শিক্ষা যা একজন শিক্ষার্থীকে মানবিক, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে সহায়তা করে। এই শিক্ষা অর্জন করে শিক্ষার্থী ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রয়োগ করে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। গুণগত শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা কেবল শিক্ষকের কাছ থেকেই শিক্ষা লাভ করে না বরং একে অন্যের কাছ থেকেও শেখে; কেবল শুনে নয় বরং দেখেও শেখে। এ ধরনের মিথস্ক্রিয়ার ফলে শিশুর সৃজনশীল শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুয়োগ হয়। ফলে তার অর্জিত শিক্ষা ও যোগ্যতা টেকসই হয়। প্রত্যেক শিক্ষকের পেশাগত দায়িত্বের অংশ হলো শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থী কী শিখতে পারছে, কী মাত্রায় এবং কতটা ভালোভাবে শিখতে পারছে সে সম্পর্কে অবহিত হয়ে সর্বোচ্চ শিখন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা যাচাইয়ের পাশাপাশি শিক্ষকের আত্মমূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি করে। এতে টেকসই যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নে শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মূল্যায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বাস্তবধর্মী ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। প্রগতিশীল বিশ্বে মেধাভিত্তিক, চিন্তাশীল, বিজ্ঞানমনস্ক স্মার্ট জাতি গঠনের জন্য বাস্তবভিত্তিক ও প্রয়োগমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর এ কারণেই টেকসই যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা আবশ্যক।
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ বাস্তবায়নের জন্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্প, কর্মসূচি ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করে তা টেকসই করার লক্ষ্যে সরকার নিয়েছেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা। সরকার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০২১-২০২৫) প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত যেসকল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তা হলো - শিশু শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা, সকল বিদ্যালয়ে মানসম্মত বই সরবরাহ করা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মান উন্নত করা, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখা এবং আওতা বৃদ্ধি করা, একীভূত শিক্ষার কার্যক্রম বৃদ্ধি, শতভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি কার্যক্রম সম্প্রসারণ, স্কুল ফিডিং/মিল কর্মসূচি সম্প্রসারণ, নতুন বিদ্যালয় এবং ক্লাসরুম নির্মাণ, বিদ্যালয়ের School Level Improvement Plan (SLIP) কার্যক্রমে এলাকাভিত্তিক সংগঠনসমূহের সহযোগিতা বৃদ্ধি, বিদ্যালয়সমূহের বার্ষিক ভিত্তিতে জরিপ সম্পন্নকরণ, প্রধান শিক্ষকদের লিডারশিপ প্রশিক্ষণ প্রদান, স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং সুশাসন, Performance এবং Need-Based প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মসূচি।
অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মানের টেকসই ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এখন আরও একধাপ এগিয়ে। তাই বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষাও হচ্ছে টেকসই। ২০৪১ সালের উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক গড়ে উঠুক আন্তর্জাতিক মানের টেকসই মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে - সেই প্রত্যাশা থাকুক আমাদের সকলের।