ধানের জেলা নওগাঁ এখন আমের নতুন রাজধানী। এখানকার তিন ফসলি ধানি জমিতে গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক আমবাগান। লাভজনক হওয়ায় বাড়ছে আমের চাষ। কেবল নওগাঁ নয়, বাণিজ্যিক আমবাগান ছড়িয়েছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নাটোরেও। কৃষি দপ্তরের হিসাবে, এক যুগের ব্যবধানে আমবাগান এবং ফলন দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। কিন্তু সেই অর্থে বাড়েনি বাজার। ফলে ভরা মৌসুমে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না চাষি-বাগান মালিকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আম এখন রপ্তানিমুখী করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে বাড়তি সুবিধা দেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষিরসাপাতি এবং রাজশাহী-চাঁপাইনবাবঞ্জের ফজলির জিআই স্বীকৃতি। আম রপ্তানিমুখি না করা গেলে অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে এমন শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১১-১২ মৌসুমে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মোট আমবাগান ছিল ৪২ হাজার ৪১৭ হেক্টর। চলতি মৌসুমে এই চার জেলায় আমবাগান দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার ৮৯৪ হেক্টরে। সেই হিসেবে গত এক যুগে এই অঞ্চলে আমবাগান বেড়েছে ৪৮ হাজার ৪৭৭ হেক্টর। অন্যদিকে ২০১১-১২ মৌসুমে এই চার জেলায় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৩ টন আম উৎপাদন হয়েছে। চলতি মৌসুমে আম উৎপাদন হয়েছে ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৯১৩ টন। এই চার জেলায় গত এক যুগে আম উৎপাদন বেড়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৮৪০ টন। আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের হিসেবে, ২০১১-১২ মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৩ হাজার ২৮০, রাজশাহীতে ৮ হাজার ৯৮৬ , নওগাঁয় ৭ হাজার ৮০১ এবং নাটোরে ২ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিল। আর চলতি মৌসুমে আমবাগান দাঁড়িয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৭ হাজার ১৬৫, নওগাঁয় ২৯ হাজার ৪৭৫, রাজশাহীতে ১৮ হাজার ৫১৬ এবং নাটোরে ৫ হাজার ৭৩৯ হেক্টরে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের অধিকাংশ আমবাগান শতবর্ষী। এখানে সনাতন আমের জাতের আবাদ বেশি হয়। কিন্তু নওগাঁর আমবাগানগুলো নতুন ও উচ্চফলনশীল জাতের। পুরো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই এসব বাগান তৈরি করা হয়েছে। ফলে নওগাঁয় গড় ফলন বেশি হচ্ছে। এ কারণে বাড়তি মুনাফা পাচ্ছেন নওগাঁর কৃষক। আমের রাজ্যে তাই নওগাঁর উত্থান দ্রুতই। আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের হসোবে, চলতি মৌসুমে নওগাঁ থেকে ৭৭, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ২৫ এবং রাজশাহী থেকে ২১ টন আম রপ্তানি হয়েছে। যা মোট উৎপাদিত আমের সামান্য একটি অংশ। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে সেইভাবে আম রপ্তানি করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রাজশাহীর চুক্তিভিত্তিক আমচাষি শফিকুল হক ছানা। ২০১৫ সাল থেকে আম রপ্তানি করে আসছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার এই চাষি। শফিকুল হক ছানা বলেন, আমাদের আম সুস্বাদু। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই আমের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু রপ্তানির উদ্দেশ্যে এখান থেকে আম ঢাকায় কোয়ারেন্টাইনে নিতে হয়। সেখান থেকে প্যাকিং হাউসে নিতে হয় আরেক জায়গায়। এরপর আম যায় বিমানবন্দরে। এটি একটি লম্বা প্রক্রিয়া। এতে খরচ বেড়ে যায়। আমও নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারছি না। কৃষকের কাছাকাছি সমন্বিত প্যাকিং হাউস গড়ে ওঠা দরকার বলে জানিয়েছেন শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতের পর সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে আম। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় বাণিজ্যিক আমবাগানে উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে আম উৎপাদন হচ্ছে। এই আম পুরোপুরি রপ্তানি করা সম্ভব। এখন প্রয়োজন সমন্বিত প্যাকিং হাউস। যেসব এলাকায় আম উৎপাদন হয়, সেখানে সমন্বিত প্যাকিং হাউস গড়ে ওঠা দরকার। যাতে সরাসরি কৃষক নিজেদের উৎপাদিত আম সেখানে নিয়ে যেতে পারেন। আম উৎপাদন এলাকায় সমন্বিত প্যাকিং হাউসের পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইন সুবিধা থাকাও জরুরি বলে জানিয়েছেন রাজশাহী এগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটির সভাপতি আনোয়ারুল হক। তিনি বলেন, ২০১৬ সালের দিকে বাগন থেকে প্যাকেটজাত হয়ে আম সোজা ঢাকায় বিমানবন্দর যেত। সেখান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে গেছে আম। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে বিড়ম্বনা শুরু। বাগান থেকে ঢাকায় কোয়ারেন্টাইন স্টেশন-প্যাকিং হাউসে নিতে গিয়ে অনেক আম নাড়াচাড়ায় নষ্ট হয়ে যায়। আবার পরিবহন ব্যয় বাড়ে। সবমিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে হয় আমাদের। তিনি যোগ করেন, দেশের আমের জোন রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সরাসরি বাগান থেকে আম রপ্তানির উদ্দেশ্যে কোয়ারেন্টইন সুবিধাসহ সমন্বিত প্যাকিং হাউস নির্মাণ করা দরকার। তাহলে এই অঞ্চলের আমচাষিরা এখান থেকেই রপ্তানি সুবিধা পাবেন। জানা গেছে, গত ২৮ জুলাই রাজশাহীতে এসেছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি স্থানীয় আম রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে মন্ত্রী রাজশাহীতে সমন্বিত ওয়ারহাউস নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। এর আগে গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম গবেষণা কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে এসে এই অঞ্চলে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণের প্রতিশ্রিুতি দিয়ে যান মন্ত্রী। তবে তার আগেেই রাজশাহী অঞ্চলে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরায় এবং রাজশাহীর পবায় আলাদা প্ল্যান্ট স্থাপনের কথা। এর মধ্যে রাজশাহীর পবায় ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি স্থাপন করবে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। প্রায় ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির সম্ভাব্য মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু এখন প্রকল্পটি অনুমোদন পায়নি। বিএমডিএর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, তারা যে প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি ঘণ্টায় ৩ হাজার কেজি ধরে দৈনিক প্রায় ৫০ টন আম প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। মৌসুমের প্রায় ৫ হাজার টন আম প্রক্রিয়াজাত করা যাবে এখানে। যার রপ্তানি মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার ওপরে। কেবল আম প্রক্রিয়াজাত করেই প্ল্যান্ট থেকে মৌসুমে আয় হবে অন্তত কোটি টাকা। আম ছাড়াও রপ্তানির উদ্দেশ্যে শাক-সবজিও প্রক্রিয়াজাত করা যাবে এই প্ল্যান্টে। এই বিপুল কর্মযজ্ঞ এই অঞ্চলের অর্থনীতির গতি পাল্টে দেবে। সূত্রটি আরও জানাচ্ছে, রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে রাজশাহী বিমানবন্দর সংলগ্ন তকিপুর মৌজায় এই প্ল্যান্ট স্থাপনের কথা। এজন্য ৬০ শতক জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে। রাজশাহী বিমানবন্দরে কার্গো সুবিধা চালু হলে এখান থেকে সহজেই রপ্তানি করা যাবে আমসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য। এই প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করছেন বিএমডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এটি একটি সমন্বিত প্ল্যান্ট। একইসঙ্গে এটি আধুনিক ও সয়ংক্রিয়। আম সংগ্রহের পর প্রথম ধাপে পরিপক্বতা যাচাই করা হয়। এরপর বিচ্ছিন্ন করা হবে বোটা। পরের ধাপে আকার অনুযায়ী বাছাই। এরপর ধৌতকরণ। এর পরের ধাপে গরম পানির ধারায় রোগ-জীবাণুমুক্তকরণ করার পর ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট করা য়। এই ধাপেরই কোয়ারেন্টাইন জীবাণুমুক্তকরণ হবে। লেবেলিং বা মোড়ানোর পর চলে যাবে প্যাকেটজাতকরণে। প্রি-কুলিংয়ের পর আম যাবে অস্থায়ী গুদামে। সেখান থেকেই রপ্তানির উদ্দেশে বেরিয়ে যাবে আম। এটি সময়োপযোগী উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের সদ্য সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমাদের হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে। আপাতত আমরা হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট করে আম বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে থাকি। কিন্তু ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করা আমের প্রচুর চাহিদা জাপানসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। রাজশাহীতে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হলে এসব দেশে আম রপ্তানির সুযোগ মিলবে। কৃষকরা আমের ভালো দাম পাবেন। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষিরসাপাতি এবং রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। উত্তম ব্যবস্থাপনায় চাষ করা গেলে ফজলি-ক্ষিরসাপাতি রপ্তানিতে কৃষক বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন। হাতের কাছে রপ্তানি সুবিধা পেলে লাভবান হতে পারেন চাষি ও রপ্তানিকারকরা। ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন বিষয়ে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদ বলেন, রাজশাহী বিএমডিএর আওতাধীন এলাকা হওয়ায় বিএমডিএকে এই অঞ্চলে ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেন কৃষিমন্ত্রী। পরে বিএমডিএ এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প দাখিল করে। এই প্রকল্পটি এখন পরিকল্পনা কমিশনের সবুজ পাতায় রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে বিশেষ সুবিধা পাবেন এখানকার আমচাষি এবং রপ্তানিকারকরা। পাশাপাশি এই প্রকল্পের সফলতা দেখে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এগিয়ে আসবেন অনেকে। এই অঞ্চলে আম উৎপাদন ও বাণিজ্যিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খানের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, খরাপ্রবণ রাজশাহী অঞ্চলে সেচের পানির ঘাটতি আছে। কজেই পানি সাশ্রয়ী আমবাগানে ঝুঁকছেন চাষিরা। এই কারণে প্রতি বছরই বাড়ছে আমবাগান এবং আম উৎপাদন। তিনি আরও বলেন, দেশের ভেতরে আমের বিপণন প্রক্রিয়া আধুনিক করা দরকার। তাছাড়া দেশের বাইরেও বাজার খোঁজা জরুরি। সরকারের এখানে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারে। রপ্তানি প্রক্রিয়াটা আরও সহজ করা যেতে পারে।
|