প্রধান প্রতিবেদক আবুল মনসুর আহমেদ :
দেশে ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে এইডসে (এইচআইভি বা হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস) আক্রান্ত হয়েছেন ৯৪৭ জন। এর মাঝে মারা গেছেন ২৩২ জন। এ ছাড়া দেশে মোট রোগী এইডস রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজার ৫১৩ জন। অর্থাৎ প্রায় চার হাজার রোগী চিকিৎসার বাইরে আছেন। তারা নিজেদের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যদেরও ঝুঁকিতে ফেলছেন। কারণ তারা শনাক্ত না হলে তাদের পরিবারই সবার আগে ঝুঁকিতে থাকবেন। বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এসব কথা বলেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, আমাদের সংক্রমণ হার দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে তা শূন্যতে নামিয়ে আনতে চাই। এজন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য সকল রোগীদের পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি জেলা উপজেলা হাসপাতালে এইডস পরীক্ষার ব্যবস্থা রখতে হবে। সংশ্লিষ্ট সকলকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
সামাজিক স্টিগমা ছেড়ে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে এইডস রোগীর সংখ্যা অনেক রোগী রয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে রোগীর সংখ্যা কম। আমরা তা ধরে রাখতে চাই। দেশে এইডসের আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে এইডসের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সকল ধরনের গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। তাই সামাজিক লজ্জাবোধের জন্য চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন না। এইডস নিয়ে সকল সামাজিক স্টিগমা দূর করতে হবে।
পরিচ্ছন্ন জীবনের পরামর্শ দিয়ে মন্ত্রী আরও বলেন, সংক্রামক ব্যাধি থেকে বাঁচতে হলে, জীবনকে আরও শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতে হবে। আমাদের দেশে কোটি মানুষ বাইরের দেশে চাকরি করে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা ফেরত ব্যক্তিদের মধ্যে এইডস বেশি পাওয়া যায়। তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও এইডস পাওয়া যাচ্ছে। দেশ থেকে যাওয়ার সময় সকলেই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান কিন্তু আসার সময় কোনো পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় এই রোগ দেশে ছড়াচ্ছে। আক্রান্তরা না জেনেই পরিবারের সদস্যদের এই রোগে আক্রান্ত করছে।
বিদেশ থেকে যারা দেশে আসেন তাদের এইচআইভি পরীক্ষা করা প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে জাহিদ মালেক বলেন, চিকিৎসা না নিলে এইডস একটি ভয়ানক ব্যাধি। এইডস একজনের থেকে আরেকজনের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে অনিয়ন্ত্রিত জীবনের কারণে। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা কম। আমরা সেটাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। সরকার এইডস রোগীর চিকিৎসা বিনামূল্যে দিয়ে যাচ্ছে। যারা এইডস আক্রান্ত হয়েও চিকিৎসা নেন না, তারা মৃত্যুর মুখে পতিত হবে। আমরা চাই বাংলাদেশ থেকে এইডস নির্মূল হোক।
তিনি বলেন, সামাজিক কারণে অনেকে এইডসের চিকিৎসা নেন না। কেউ যদি জানেন তার এইডস আছে, তাহলে চিকিৎসা নেবেন এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখবেন। এইডস আক্রান্ত রোগীদের আমাদের সহানুভূতির সঙ্গে দেখা প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় যারা কাজ করেন, সেখান থেকে ফেরত আসা ব্যক্তিদের মধ্যে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। তাদের পরিবারের সদস্যরাও এইডসে বেশি আক্রান্ত হন। এ সংখ্যা ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশি। বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার সময় এইচআইভি পরীক্ষা করে ভিসা নিতে হয়। কিন্তু যখন বিদেশ থেকে ফিরে আসে তখন এইচআইভি পরীক্ষা করা হয় না। যাওয়ার সময় যদি এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়, তাহলে আমি মনে করি বিদেশে কাজ শেষে দেশে ফিরে আসার সময়ও এইচআইভি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। বিদেশ থেকে ফেরার সময় তার নিজের জন্য ও তার পরিবারের সুরক্ষার জন্য এইচআইভি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এটা করলে এইডস রোগীর সংখ্যা পর্যায়ক্রমে কমে যাবে।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল (এনএএসসি) প্রোগ্রামের তথ্যানুযায়ী, ২০২১সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১২ লাখ ৪১ হাজার ৬২৫ জনের এইচআইভি পরীক্ষা করে নতুন করে ৯৪৭ জন শনাক্ত হয়। এর মধ্যে ১২৮ জন রোহিঙ্গা। এ নিয়ে মোট শনাক্তকৃত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৯ হাজার ৭০৮ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে এইডস আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১ হাজার ৮২০ জন। আর এইডস সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ঢাকা বিভাগে ২৪০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০৭ জন,খুলনা বিভাগে ১২৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ৯৬ জন, সিলেট বিভাগে ৫৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২১, বরিশালে ৫৮ এবং রংপুর বিভাগে ১৮ জন। এছাড়া ১২৮ জন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর।
গত এক বছরে নতুন আক্রান্তদের মধ্যে সাধারণ জনগোষ্ঠী ৩৩ শতাংশ, রোহিঙ্গা ১৩ শতাংশ, বিদেশফেরত প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্য ৮ শতাংশ, ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ১১ শতাংশ , নারী যৌনকর্মী ১ শতাংশ, সমকামী ১৪ শতাংশ, পুরুষ যৌনকর্মী ৯ শতাংশ ও ট্রান্সজেন্ডার ১ শতাংশ রয়েছেন। আক্রান্তদের ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ, নারী ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ট্রান্সজেন্ডার শুন্য দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে বিবাহিত ৬৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ ও অবিবাহিত ২৯ দশমিক ০৪ শতাংশ। অন্যান্য ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বয়স বেধে ২৫ থেকে ৪৯ বছরের আক্রান্ত হার ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ ৫০ ঊর্ধ্ব ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং শুন্য থেকে ১৮ বছরের ৬ শতাংশ রয়েছে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস ও এসটিডি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. খুরশীদ আলম। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (এনডিসি) ডা. আশরাফী আহমেদ, জাতিসংঘের প্রতিনিধি রাজেন্দ্র বোহরা এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর প্রমুখ।
|