দেশের একদা প্রত্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের পথে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগে বিপ্লব এনেছে পদ্মা সেতু। সেই আলোচিত, বহুল প্রতীক্ষিত সেতুর আজ দুই বছর পূর্ণ হলো। ২০২২ সালের ২৫ জুন চালু হয় পদ্মা সেতু। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু পদ্মা নদী দিয়ে বিচ্ছিন্ন দক্ষিণকে মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে এক সুতায় বেঁধেছে।
দেশের ইতিহাসে যোগাযোগ খাতে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো এই সেতু। ২০২২ সালের এই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন। এর এক দিন পর থেকেই শুরু হয় সেতুতে যান চলাচল। যেন দেখতে দেখতেই সেতু চালু হওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেল।
পদ্মা সেতু দিয়ে এ পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে প্রায় সোয়া এক কোটি গাড়ি। সেতুর নিচের তলা দিয়ে চলছে ট্রেন। তবে ট্রেন চলাচল এখনো আংশিক। আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত পুরো পথে ট্রেন চলবে।
পদ্মা সেতুর প্রভাবে বদলে গেছে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে নদীবহুল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাতায়াত। যাত্রার সময় কমেছে চমকপ্রদভাবে। নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে সড়ক যোগাযোগ ক্ষেত্রে। সার্বিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এই সেতু।
দুই বছর আগেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে রাজধানী ঢাকায় আসতে দীর্ঘ সময় ফেরিঘাটে অপেক্ষা করতে হতো। যানজট, কুয়াশার মতো বিপত্তি বা ফেরির সমস্যা হলে দুর্ভোগের শেষ ছিল না। শারীরিক-মানসিক ভোগান্তি ছাড়াও সময়ের অপচয় হতো। পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় একেকটি স্প্যান বসার খবরের দিকে অধীর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ রেখেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষসহ দেশবাসী। কারিগরিসহ নানা চ্যালেঞ্জ পেছনে ঠেলে বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে নির্মিত হয় সেতুটি। অবসান ঘটে যাত্রীদের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের। এখন খুব সহজেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত করতে পারছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে পদ্মা সেতু, যা এখন দৃশ্যমান। সেতু চালু হওয়ার পর যে সংখ্যায় যানবাহন পারাপার হওয়ার কথা ছিল, তার থেকে দ্বিগুণ যানবাহন চলছে। তার মানে অনেক মানুষ সেতুতে যাতায়াত করছে, সুবিধা পাচ্ছে।’
পদ্মা সেতুকে কার্যকরভাবে ব্যবহারের তাগিদ দিয়ে অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘মেগাপ্রকল্পগুলো শুধু যাতায়াতের করিডর না থেকে অর্থনৈতিক করিডরে রূপান্তরিত হতে হবে। সেই জায়গাটাতে কাজ করতে হবে।’
পুরো দেশের পদ্মা সেতুর সুবিধা পাওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ রিং রোড তৈরির পরামর্শ দেন অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। তাঁর মতে, হানিফ ফ্লাইওভারের সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ নেই। ‘ইনার রিং রোড’ হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ সহজ হবে।
সেতুতে চলেছে কোটির বেশি গাড়ি
পদ্মা সেতু পারাপারে ১৩ ধরনের যানবাহনের জন্য টোল নির্ধারণ করা আছে। ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত টোল থেকে এক হাজার ৬৪৫ কোটি ২৪ লাখ ৯৮ হাজার ১৫০ টাকা আয় হয়েছে। মোট যান পারাপার হয়েছে এক কোটি ২৪ লাখ ৫১ হাজার ৯৯৫টি। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পূর্বাভাসে যা বলা হয়েছিল তার আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি টোল আদায় হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে ২০১২ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর সেতুর মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়।
সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে। এর নির্মাণ ব্যয়ের অর্থ সেতু বিভাগকে ধার দিয়েছে সরকারের অর্থ বিভাগ। আগামী ২০৫৭ সাল পর্যন্ত ১ শতাংশ সুদসহ ১৪০টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে ঋণের এই টাকা অর্থ বিভাগকে পরিশোধ করবে সেতু বিভাগ।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা সেতুর ফলে বহু মানুষ সুবিধা পাচ্ছে এটাই আমাদের জন্য বড় অর্জন। এর সঙ্গে সেতুটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক আরো অনেক প্রভাব রয়েছে। এই সেতু আমাদের দেশের জন্য একটি মাইলফলক।’
২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে উল্লেখ করে মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এরই মধ্যে সেতুর নদীশাসনসহ সব কাজ শেষ হয়েছে।
দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর অবদানের বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এই সেতু দেশের অর্থনীতিতে অবশ্যই অবদান রাখছে। আশা করছি নির্মাণ ব্যয় খুব দ্রুতই উঠে আসবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ উন্নয়নের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরো গতিশীল ও বিকশিত হচ্ছে। ফলে এই সেতু প্রত্যক্ষভাবেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
জীবন সহজ করেছে এই সেতু
ঢাকা থেকে পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে যেসব মানুষ দক্ষিণের জেলাগুলোয় যেত, তাদের বড় অংশ এখন পদ্মা সেতু দিয়ে যাচ্ছে। এতে যাতায়াতের দূরত্ব, সময় এবং ব্যয় সবই কমেছে।
পদ্মা সেতু চালুর পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থার পুরো চিত্রই পাল্টে গেছে। সড়ক পরিবহন ব্যবসার প্রসার হয়েছে। খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে নতুন নতুন বিলাসবহুল বাস চলাচল শুরু হয়েছে। এসব অঞ্চলের মানুষ এখন সকালে ঢাকায় এসে কাজ সেরে বিকেল বা সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফিরে যেতে পারছে। তবে সেতুর অনিবার্য প্রভাবে নৌপথে যাত্রী কমেছে। কমেছে লঞ্চঘাটের একসময়ের রমরমা ভাব।
বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর ঘোষ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর আগে ঢাকা-খুলনা যাতায়াত এত সহজ ছিল না। মাওয়া ফেরিঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিলম্ব হতো। এখন ঢাকা থেকে খুলনা মাত্র চার ঘণ্টায় যেতে পারছে যাত্রীরা।’
এখন অপেক্ষা পুরো পথে ট্রেন চলার
পদ্মা সেতুর নিচে রেলপথ ওপরে সড়কপথ। ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথের উদ্বোধন করা হয়েছিল। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেললাইন নির্মাণ করছে। এর ৮২ কিলোমিটার অংশ ঢাকা ও ভাঙ্গাকে সংযুক্ত করেছে, যা ১০ অক্টোবর খুলে দেওয়া হয়। লাইনের যশোর পর্যন্ত বাকি অংশ এ মাসের মধ্যে চালু করার পরিকল্পনা ছিল।
বর্তমানে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে ছয়টি ট্রেন চলাচল করছে। ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত রেললাইনের কাজ শেষ হলে এই রুটে ট্রেন চলাচল আরো বাড়বে।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, এই প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ শতাংশ। ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত রেললাইন বসে গেছে। তবে কথা থাকলেও যশোর পর্যন্ত ট্রেন চলাচল এ মাসের মধ্যে শুরু হচ্ছে না।
|