ভাঙ্গা-পায়রা রেলপথ নির্মাণ: প্রস্তুতি প্রায় শেষ, ঋণ দিতে পারে চীন
Date : 29-6-2024
ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন থেকে পায়রা বন্দর এবং বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত একটি নতুন রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। এর মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে রেলের নতুন মেরুকরণ হবে। রেলপথেও নির্মাণকাজ শুরুর আগের প্রস্তুতিমূলক প্রায় সব কাজ শেষ। কিন্তু অর্থায়ন না হওয়ায় অবকাঠামোর কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে এই প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ দেবে চীন। রেলওয়ে সূত্র বলছে, এই প্রকল্পে চীনের আগ্রহ রয়েছে। সম্প্রতি প্রকল্পের সম্যক ধারণা নিতে বরিশাল গিয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
ভাঙ্গা থেকে বরিশাল-পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ২১৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আর রেলপথ উড়াল করা হলে নির্মাণ খরচ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে বর্তমান প্রাক-উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (পিডিপিপি) এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা নেই। এ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার কাছে প্রস্তাব করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনো অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি।
জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ুন কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, রেলের আসন্ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে অগ্রাধিকারে আছে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে এটি থাকতে পারে। চীনের অর্থায়ন হতে পারে।
উন্মুক্ত দরপত্র না-ও হতে পারে
প্রকল্পের অর্থায়নের ব্যবস্থা হলে শুরু হবে দরপত্র আহ্বান, যাচাই-বাছাই, জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ।
তবে দরপত্রের ধরন কেমন হবে, সেটা নির্ভর করছে ঋণের চুক্তির ওপর। অর্থায়নকারী দেশ বা প্রতিষ্ঠান ঠিকাদার নির্ধারণ করে দিলে উন্মুক্ত দরপত্রের সুযোগ থাকবে না।
রেলের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, অর্থায়নকারী দেশের চুক্তির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। যদি চীন অর্থায়ন করে তাহলে চীনের মধ্যে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। সরাসরি ঠিকাদার নিয়োগের আলোচনাও হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে দরপত্রের কাজ হবে। নির্মাণের জন্য সাড়ে পাঁচ বছর সময় ধরে ২০৩০ সালে ট্রেনে চড়েই কুয়াকাটা যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে রেলওয়ে।
পিডিপিপির নথির তথ্য বলছে, ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রেলপথে থাকবে না কোনো লেভেলক্রসিং। সড়ক ও রেলপথের সংযোগ ঘটবে যেসব জায়গায়, সেখানে তৈরি করা হবে বক্স কালভার্ট। এতে করে বক্সের ভেতরে ট্রেন এবং নিচ দিয়ে সড়কপথে যান চলাচল করবে। এই রেলপথ হবে ব্রড গেজ। এতে ভবিষ্যতে যেন বৈদ্যুতিক ট্রেন চালানো যায়, সেই ব্যবস্থাও রাখা হবে। এই পথে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৬০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারবে।
কোন পথে যাবে ট্রেন, স্টেশন কয়টি
ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা যাবে ট্রেন। পায়রা বন্দর ঘিরে রেলওয়ে অর্থনৈতিক জোন করতে চায় রেলপথ মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে এই প্রকল্পের অধীনে বরিশালেও রেলওয়ে মাল্টিমোডাল হাব নির্মাণ করা হবে। এই দুই জায়গাসহ এই পথে মোট ১৯টি বড় রেলস্টেশন নির্মাণ করা হবে। পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার নিচু জমিতে হবে উড়াল (এলিভেটেড) রেলপথ।
ঢাকার সঙ্গে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ স্থাপন হলেও প্রকল্পের অধীনে ভাঙ্গা জংশন স্টেশনকে ১ নম্বর স্টেশন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এরপর মাদারীপুর, বরিশাল ও কুয়াকাটাকে তিনটি প্রধান স্টেশন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। মধ্যবর্তী স্টেশন থাকবে আরো ৯টি। সেগুলো হলো টেকেরহাট, গৌরনদী, বরিশাল বিমানবন্দর, বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী, আমতলী, পায়রা বন্দর, পায়রা বন্দর ইয়ার্ড এবং লেমুপাড়া। এ ছাড়া ছুটির স্টেশন থাকবে আরো ছয়টি। এগুলো হলো বড়ইতলা, কালকিনি, ওয়াজরীপুর, দাপডাপাই, বাদারপুর ও কুকুয়া।
দৈর্ঘ্য বিবেচনায় কেন এত খরচ
পরিকল্পনা অনুযায়ী, সব কিছু মিলিয়ে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে খরচ হবে ১১৩ কোটি ১৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ এবং পুনর্বাসন ছাড়া প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ৮৯ কোটি ৭০ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা। যদি পুরো পথে রেললাইন নির্মাণ, সেতু, কালভার্ট, স্টেশন এবং স্টেশন ভবন নির্মাণ বিবেচনা করা হয়; সে ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ৪৪ কোটি ১৯ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। তবে শুধু রেললাইন বসাতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
বরিশাল অঞ্চলে নিচু জমি আর বড় নদীর সংখ্যা বেশি। অনেক জমি উঁচু করতে হবে। উড়াল রেলপথ ও বড় বড় সেতুও নির্মাণ করতে হবে। এসব কারণেই ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আবার প্রকল্পের অধীনে কালীগঙ্গা, আমতলী, আন্ধারমানিক, কীর্তনখোলা, পায়রাসহ মোট ১০টি নদীতে নির্মাণ করা হবে ৪৬টি বড় রেলসেতু। থাকবে ৪৪০টি বক্স কালভার্ট।
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরিচালক মামুনুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রথম পর্যায়ে এই পথে দিনে-রাতে দুটি ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা আছে। এতে ভ্রমণকারীরা রাতে ট্রেনে চড়ে সকালে কুয়াকাটা পৌঁছে যেতে পারবে।
সংশোধন হচ্ছে পিডিপিপি
প্রাক-উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) হচ্ছে প্রকল্পের সামগ্রিক ধারণার কেন্দ্রবিন্দু। তবে এটি শতভাগ চূড়ান্ত থাকে না। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের আলোচনার ভিত্তিতে পরিবর্তন আনা হয়। এখানেও অর্থায়ন পাওয়ার আগে পিডিপিপিতে কিছু পরিবর্তন আনছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি রেল ভবনে এই প্রকল্পের ওপর একটি সমন্বয় সভা হয়। সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে বিভিন্ন মতামত নেওয়া হয়েছে। এই সভায় অংশ নেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক।
শামসুল হক বলেন, নরম মাটির কারণে অনেক জায়গায় রেলপথ নির্মাণের জন্য উচু বাঁধ তৈরি করতে হবে। সেটি স্থানীয়দের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। পানির প্রবাহে বাধা পেতে পারে। তাই ওই সব জায়গায়ও রেলপথ উড়ালে বানানো যায় কি না, সেটি এখনো ভেবে দেখার সুযোগ আছে। খুঁটিনির্ভর পথ হলে লম্বা বাঁধ তৈরি হবে না। নিচের পথ স্বাভাবিক থাকবে। উড়ালে খরচ বাড়লেও ভূমি অধিগ্রহণে খরচ থাকবে না।