পূর্বাকাশে সূর্য উঁকি দিয়েছে। বঙ্গোপসাগর থেকে চরফ্যাশনের সামরাজ বাজারে এসে ভিড়ছে ইলিশ বোঝাই জেলে ট্রলার। ট্রলার থেকে ঝুড়ি ভর্তি মাছ আসছে আড়তে। তার আগে ইলিশ বাক্সে হাঁকা হচ্ছে দর।
মুহূর্তে বেচাকেনা শেষ। মাছের গন্তব্য আড়তদারের আইসবাক্স। এখান থেকে মাছ যাবে বড় আড়তে। এজন্য ছোট ছোট পিকআপ ভ্যান প্রস্তুত রয়েছে।
সামরাজ বাজারের প্রতিদিনের চিত্র এটি।
যদিও বঙ্গোপসাগরে সকল ধরনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলছে; সেখানে বাস্তব চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। নেই নিষেধাজ্ঞা, নেই অবরোধ। ব্যস্ত সময় মাছঘাটে, মাছ বাজারে।
শুধু যে ইলিশ ধরা, কিংবা ইলিশ বেচাকেনার সঙ্গে জড়িতরাই নন, উপকূলের দ্বীপ জেলা ভোলার সামরাজ মাছঘাটের জেলে আর ট্রলারের আনাগোনায় ব্যস্ত সময় কাটছে এখানে। বাজারের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে মুদী দোকানগুলোতে ভিড় বেড়েছে।
সামরাজের মতো এমন বেশকিছু হাট গড়ে উঠেছে, যেখানে মূলত ইলিশ কেনাবেচা হচ্ছে। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন জেলাটিই এখন দেশে ইলিশের সবচেয়ে বড় উৎসে পরিণত হয়েছে। বঙ্গোপসাগর, মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা জেলাটিকে এখন কেউ কেউ অভিহিত করছেন ইলিশের খনি হিসেবে।
মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকা অঞ্চলে যত ইলিশ পাওয়া যায়, তার অর্ধেকই ধরা পড়ে ভোলার জলসীমায়। সাগরে মাছের আনাগোনা বাড়লেও ইলিশের খনি হিসেবে পরিচিত মেঘনা আর তেঁতুলিয়ায় মাছের দেখা নেই।
সামরাজ মাছঘাটে ইলিশ বোঝাই করে সাগর থেকে এফবি ময়না নামের ট্রলার আসলো। সেই ট্রলার থেকে ইলিশ তুলে আনছিলেন জেলে আ. রহিম। প্রায় ১৭ মন মাছ পেয়েছেন তিনি। ট্রলারে ১৪ জন জেলে রয়েছেন। এক সপ্তাহ ধরে তারা সাগরে মাছ শিকার করেছেন। দীর্ঘ সময় সাগরে থাকায় ধরা পড়া ইলিশ অনেকটা লালচে রঙ ধারণ করেছে। তাই এই মাছের দাম একটু কম হবে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সমুদ্রযাত্রার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হারুন মাঝি বলেন, দাদন নিয়েছি। মাছ দিতেই হবে। তাই সাগরে গিয়েছি।
রবিবার (১১ মার্চ) সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত এ প্রতিবেদক সামরাজ বাজার ঘুরে দেখেছেন। এই সময়ে অন্তত ১৭টি ট্রলার সাগর থেকে সামরাজ বাজারে ফিরেছে। জেলেরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে রাতে ট্রলার সামরাজ বাজারে আসে। যারা স্রোতের বিপরীতে থাকেন তাদের তীরে ফিরতে সকাল হয়ে যায়। সামরাজ বাজারে গিয়ে বাক্স ভর্তি ইলিশের দেখা মিলেছে। প্রকাশ্যেই সেই ইলিশ নিলাম ডেকে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে সকালে সামরাজ মাছ ঘাটে প্রশাসনের কাউকে দেখা যায়নি। আড়তদাররা বলছেন, মাছ কম পড়ে তাই প্রশাসন সামরাজ বাজার এড়িয়ে চলেন।
সামরাজ মৎস্য ঘাটের আড়তদার হেলাল উদ্দিন টিপু বলেন, নদী ও সমুদ্রে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন জেলেদের দুর্বিষহ জীবন পার করতে হয়। বিশেষ করে সংসারের খোরাক যোগাতে হিমশিম খেতে হয় জেলেদের। এমনকি বাড়তি সুদের ঋণে জড়িয়ে যান তারা। এমন পরিস্থিতিতে কেউ কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ শিকার করছে। তবে সেই ধরনের জেলের সংখ্যা খুবই কম।
সামরাজ মৎস্যঘাট জেলে সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ঘাটে ৯৮ জন মৎস্য আড়তদার রয়েছেন। এসব আড়তদাররা প্রায় দেড়শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। অধিক ঝুঁকি জেনেও তারা মাছের ব্যবসা জড়িত রয়েছেন। সাগরে নিষেধাজ্ঞা চলছে। তবুও কিছু জেলে সাগরে যাচ্ছে। কিন্তু যে মাছ পাচ্ছেন তা দিয়ে খরচ উঠছে না। বেশি মাছ না পাওয়ায় প্রশাসন এই দিকে আসেও না।
সামরাজ মৎস্য ঘাটের মতো উপজেলার বেতুয়া, নতুন স্লুইসগেট, পাঁচ কপাট, খেজুরগাছিয়া, ঢালচর, বকসীরঘাট, ঘোষেরহাট, চরকচ্ছপিয়া ও কুকরি মুকরি মাছ ঘাট রয়েছে। এই ঘাটগুলোর সঙ্গে চরফ্যাশন উপজেলায় প্রায় ৯০ হাজার জেলের জীবন-জীবিকা নির্ভর করছে। তবে উপজেলার নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৪ হাজার ৩৭৫ জন। সেই হিসেবে অনিবন্ধিত জেলে রয়েছে প্রায় ৪৬ হাজার। এসব জেলেরা নদী ও সাগরে মাছ শিকার করেন।
চরফ্যাশন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ বলেন, এ বছর নদী ও সমুদ্রে মাছ খুবই কম। জেলেদের উপর নির্ভর করে আড়তদাররা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। বঙ্গোপসাগরে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার এ বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে আগামী ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকার দুদিন আগে বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে যাবে।